Tuesday, December 19, 2017

মৃত্যু

::শাহরিমা তাবাসসুম::

-
মেয়েটা আজকেও এসেছে। পড়নে সাধারণ একটা সুতির শাড়ি,মাথার চুলগুলো আলগোছে একটা খোপা করে পেছনে নিয়ে বাঁধা,হাতে সরু ব্যাল্টের চামড়ার একটা ঘড়ি।প্রতিবারই একইরকম দেখতে।কোনো সাজসজ্জা নেই। মেয়েটা ইতস্তত পায়ে ভিতরে আসে।হেসে সালাম দেয়। তারপরের ঘটনাটা দোকানিটার জানা।মেয়েটা কাচের চুড়ি, কানের দুল এটাসেটা নেড়েচেড়ে দেখে শেষে এসে কাচের বাক্সে রাখা নূপুরগুলোর কাছে এসে থামবে। কখনো হাতে নিয়ে দেখে না। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 
আলোকোজ্জ্বল কাচের ভিতরে থাকা ঝিকমিক করতে থাকা নূপুরগুলো দেখতে দেখতে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস আসে শায়েলার।বুকের গহিনে থাকা স্বপ্নগুলো বিষ বাষ্পের মতো পাক খেতে থাকে। কষ্টের ছাপটা মুখে এসে পড়ার আগে ও হেসে হাতের কাছে থাকা এক জোড়া কানের দুল নিয়ে বলে বাহ্! সুন্দরতো।দাম কত এটার? দোকানিটা হাসে।জানে মেয়েটা এই দুল জোড়া কিনবে না।তারপরও দাম জানায়।মেয়েটা খানিক ইতস্তত করে দুল জোড়া রেখে দিয়ে পাঁচ টাকার এক পাতা চুলের ক্লিপ নিয়ে দাম চুকিয়ে বেরিয়ে যায় । মেয়েটা এপর্যন্ত কয় পাতা চুলের ক্লিপ নিয়ে গেছে?-ভাবতে গিয়ে কপালটা একটু কুঁচকে আসে দোকানিটার।বয়স হয়েছে।আগের মতো এত স্পষ্টভাবে আর সবকিছু মনে রাখতে পারেন না এখন।মেয়েটা প্রায় দুই বছরের মতো এই পাড়ার প্রাইমারিতে শিক্ষকতা করে।তারপর থেকেই তার দোকানে আসে।মাস দেড় মাসে একবার।মেয়েটার চেহারার সাথে নিলুফারের চেহারার অনেকটা মিল।নিলুফার মারা গেছে আজ দশ বছর।বিড়বিড় করে বলেন মেয়েটা এসে নিলুর কথাটা খুব বেশি মনে করিয়ে দেয়।  একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন উনি।

স্কুল ছুটি হয় চারটায়।দোকানে এসে অনেকখানি সময় নষ্ট করে ফেলেছি আজ।দোকানটা স্কুল থেকে বেশ খানিকটা দূরে।বাড়ি ফিরতে গেলে আবার উল্টো পথে হেঁটে আসতে হয়। সন্ধ্যা নেমে গেছে।হিম হিম শীত।শায়েলা মনে মনে বলে ইশশ! চাদরটা সকালে গায়ে জড়িয়ে আসলে ভালো হতো।ও দ্রুত হাঁটে।এই নৈঃশব্দ্য অন্ধকার ওর ভালো লাগছে না।হঠাৎ করে বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে ওঠে ওর।শিশির বিন্দুর মতো জল জমতে থাকে চোখে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে।আমার দ্রুত বাসায় পৌঁছানো দরকার..  মনেমনে ভাবে ও।ওখানে আলো আছে।পথের কিনারায় থাকা দিঘির কাছটায় এসে একটু থমকে দাঁড়ায়।মন খারাপ করে দেয়া কেমন বিষণ্ন কালো জল! ওর চলে যাওয়া উচিৎ। সম্মোহিতের মত তবুও দাঁড়িয়ে থাকে।আচমকাই ও আবিষ্কার করে ওর চোখ থেকে বৃষ্টির মতো জল পড়ছে।ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ও। বহু বছর আগে এক আলোকোজ্জ্বল সন্ধ্যায় প্রচন্ড অভিমান নিয়ে ও ধ্রুবকে বলেছিল আগুন ভয় লাগে আমার।আমি জলে ডুবেই মারা যাব।ধ্রুব খানিক চুপ থেকে ফিসফিস করে বলেছিল আমাকে ছাড়া ডুবতে পারবি তুই!কী এক অপার্থিব শান্তি তখন ঘিরে ধরেছিল ওকে।ও শব্দ করে কেঁদে ওঠে।এই নৈঃশব্দ্য 
অন্ধকারে দিঘির কালো জল আর কুয়াশা সেই কান্নার শব্দ গিলে খায়।
 দিঘির পাড়ে লাগানো ডালপালা ছড়ানো তেঁতুল গাছটার মাঝামাঝি একটা ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা আরো একজন প্রথম থেকেই এই দৃশ্যটা দেখছে।প্রচন্ড বিরক্তিতে মানুষের ছা টার দিকে তাকিয়ে আছে জুম্মেকা।মানুষজন ওর একদম পছন্দ না।এই রাতের বেলায়ও একটু নিরিবিলিতে থাকতে দিচ্ছে না।প্রচন্ড আক্রোশে নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলে ও। তবুও রাগ কমে না।মানুষের সাথে ঝামেলায় জড়াতে চায় না ওরা।আগের আস্তানাটাও ছেড়ে আসতে হয়েছে এই হতচ্ছাড়া মানুষদের জন্য।একজনের ঘাড় মটকে দিয়েছিল ও।মানুষগুলো ওঝা দিয়ে তাড়িয়েছে ওকে।দাঁত মুখ খিঁচে দিঘির পাড়ে বসে থাকা মেয়েটাকে মানুষের বাচ্চা বলে একটা গালি দেয় ও। আর কিছুক্ষণ দেখবে। এরমধ্যে যদি না যায় মানুষের ছা টার ঘাড় মটকে দেবে ও।

No comments:

Post a Comment

সাহিত্য পাতা

কবিতা

ডায়েরির পাতায় তুমি ইমরান হোসেন রিয়াদ নিস্তব্ধ রাতে বসে আছি পড়ার টেবিলে হাতে তোমার ডায়েরি টা। বাহিরে আকাশের দিকে তাকালাম আকাশ...